৭ জন বীরশ্রেষ্ঠের নামের তালিকা
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। ভারত বর্ষ ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করলেও ব্রিটিশরা কৌশলে ভারতবর্ষকে দুটি ভাগে ভাগ করে দেয় যার একটি হয় ভারত অন্যটি হয় পাকিস্তান। পাকিস্তান দুটি অংশে বিভক্ত ছিল, পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্য কার দূরত্ব ছিল অনেক। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান একই দেশ হলেও এই দেশের শাসনভাব ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে। পশ্চিম পাকিস্তানীরা সব ক্ষেত্রেই পূর্ব পাকিস্তানিদের অবহেলা করত। সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পশ্চিম পাকিস্তানিরা ভোগ করত। পশ্চিম পাকিস্তানিদের ভাষা ছিল উর্দু, পূর্ব পাকিস্তানিদের ভাষা ছিল বাংলা।
পশ্চিম পাকিস্তানিরা জোর করে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনতা কখনোই এটা মেনে নিতে পারেনি। আর মেনে নিতে পারবেই বা কেন? জন্মের পর থেকে একজন মানুষ যে ভাষায় কথা বলে এসেছে চাইলেই তো আর সে ভাষা ছেড়ে অন্য ভাষায় কথা বলতে শুরু করা যায় না। পূর্ব পাকিস্তানিদের মধ্যে উর্দু ভাষা জানতো হাতে গোনা কয়েকজন। সে সময় পাকিস্তানের শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা ছিল খুবই কম। তবে পাকিস্তানিরা যখন রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার দাবি জানিয়েছিল তখন পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ আন্দোলনের ডাক দেয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের কথা পুরো পৃথিবীর জানা।
সে সময় ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত, শফিউর ছাড়াও নাম না জানা অনেকেই। এই ইতিহাস আপনাদের কারোরই অজানা নয়। এরপরও আরো একবার ঘটনাগুলো মনে করিয়ে দিলাম। আপনার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আজ আমরা কোন বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলব। আজ আমরা কয়েকজন বীরের গল্প বলব। ওই যে, রফিক জব্বার বরকত শফিউর সালাম এদের কথা বললাম। এরা যেমন নিজের প্রাণ দিয়েছিলেন বাংলা ভাষা বাঁচিয়ে রাখার জন্য, ঠিক তেমনি ভাবে বাংলাদেশকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছিলেন তাদের গল্প বলব আজ। বাংলাদেশের মানুষকে বাঁচানোর জন্য, বাংলাদেশের মানুষকে শোষণের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য, বাংলাদেশের মানুষের অধিকার আদায় করার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছিলেন তাদের গল্প বলব আজ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কমবেশি সকলেই জানে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সকলে জানলেও সেই বীরের কথা কেউ হয়তো তেমনভাবে জানে না যারা নিজের জীবন বাজি রেখে আমাদের বাংলাদেশ দিয়ে গেছে। চলুন সেই বীরদের পরিচয় জেনে আসি।
(১) মুন্সি আব্দুর রউফ-পদবী:ল্যান্স নায়ক।
(২)মোঃ মোস্তফা-পদবী :সিপাহী।
(৩)মতিউর রহমান-পদবী : ফ্লাইট ল্যাফটেন্যান্ট।
(৪) নূর মোহাম্মদ শেখ-পদবী : ল্যান্স নায়ক।
(৫) হামিদুর রহমান -পদবী: সিপাহী
(৬)রুহুল আমিন-পদবী: স্কোয়াড্রন ইঞ্জিনিয়ার
(৭)মহিউদ্দিন জাহাংগীর-পদবী ক্যাপ্টেন
ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার সালামতপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মুন্সী আব্দুর রউফ। তিনি ছিলেন ইপিআরের ল্যান্স নায়েক। ১ নং সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন। তার জন্ম ১৯৪৩ সালের পহেলা মে, ১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল তারিখে তিনি শহীদ হন। সেনাবাহিনীর সিপাহী মোস্তফা কামালের নাম শোনেননি এমন মানুষ খুব কমই খুঁজে পাওয়া যাবে। ২ নং সেক্টরে যুদ্ধ করা এই বীর ভোলা জেলায় ১৯৪৭ সালের ১৬ই ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমানের বীরত্বের কথা আমরা সকলেই জানি। তিনি বিমান বাহিনীতে কাজ করতেন। দেশের হয়ে ২০শে আগস্ট তারিখে প্রাণ দেন এই বীর। ইপি আর এর আরো একজন ল্যান্সনায়েক ছিলেন নূর মোহাম্মদ শেখ। নূর মোহাম্মদ শেখ ৮ নং সেক্টরের হয়ে যুদ্ধ করতে করতে ৫ সেপ্টেম্বর শহীদ হন।
বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব পাওয়া আরো তিনজন হলেন হামিদুর রহমান, রুহুল আমিন ও মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। হামিদুর রহমান ও মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেনাবাহিনীর হয়ে কাজ করতেন। মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন ছিলেন। রুহুল আমিন ছিলেন নৌবাহিনীর স্কোয়াড্রন ইঞ্জিনিয়ার। এই হল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ যারা নিজের জীবন বাজি রেখে দেশের জন্য শেষ পর্যন্ত লড়ে গেছেন। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ এই সাতজনকে সব সময় স্মরণ করবে । বাংলাদেশ যতদিন থাকবে, প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে এই সাতজন বীরশ্রেষ্ঠের নাম থাকবে। সাতজন বীরশ্রেষ্ঠের নাম আমরা আলাদাভাবে লিস্ট করে এই পোস্টের সাথে সংযুক্ত করে দেব আপনাদের সুবিধার্থে।
আপনারা অনেক সময় বীরশ্রেষ্ঠের সাথে অন্যান্য উপাধি গুলিয়ে ফেলেন। বীরশ্রেষ্ঠ হলো সেই সাতজন যারা দেশের জন্য প্রাণ দিয়ে অতুলনীয় সাহস দেখিয়েছেন। বীরশ্রেষ্ঠ হল সর্বোচ্চ সামরিক পুরস্কার। বীরশ্রেষ্ঠ ছাড়াও বীরত্বের জন্য আরো তিনটি সামরিক পদক দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য দেওয়া আরও কিন্তু সামরিক পদক হচ্ছে বীর উত্তম, বীর বিক্রম ও বীর প্রতীক। এই চারটি পদকের মধ্যে সর্বোচ্চ পদক হলো বীরশ্রেষ্ঠ। আপনারা কি জানেন? সাতজন বীরশ্রেষ্ঠের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সে শহীদ হয়েছিলেন কোন বীর? বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী মোঃ হামিদুর রহমান মাত্র আঠারো বছর বয়সে শহীদ হয়েছিলেন।
১৯৭১ সালের সাতই মার্চ বাংলাদেশের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য আহ্বান করেন। তার ডাকে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে প্রতিহত করার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে। 25 শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙ্গালীদের উপর অমানবিক হত্যাযজ্ঞ চালায়। এরপর থেকেই বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ মুক্তির জন্য লড়াই করতে থাকে। সামরিক ও বেসামরিক প্রতিটি মানুষ প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা প্রতিটি মানুষই অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন।
ফ্লাইট লেফটনের মতিউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত ছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানের থাকা অবস্থায় যখন বাংলাদেশের যুদ্ধ শুরু হয় তখন মুক্তিযোদ্ধাদের আকাশ পথে সমর্থন দেওয়ার জন্য পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসছিলেন। পালিয়ে আসার সময় তারই সহকর্মের সাথে ধস্তাধস্তি করতে করতে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে তিনি শহীদ হন। মতিউর রহমানকে প্রথমে করাচিতে সময় তো করা হলেও পরে ঢাকায় নিয়ে এসে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
এই যে আজ আমরা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারছি, বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারছি, প্রতিটি রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা ভোগের অধিকার পাচ্ছি এর সবকিছুই সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র তাদের জন্য যারা মহান মুক্তিযুদ্ধের জীবন দিয়ে আমাদের এই বাংলাদেশ উপহার দিয়েছেন। এই বাংলাদেশ আমাদের কাছে ততটা দামি, ৩০ লক্ষ মানুষের জীবনের দাম যতটা হয়, তিন লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমের মূল্য যতটা হয় ঠিক ততটা। বাংলাদেশ আজ পুরো পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছে।
আন্তর্জাতিক সকল প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের নাম থাকছে। এই সোনার বাংলাদেশ আমরা কখনোই দেখতে পেতাম না যদি তারা আমাদের দেশকে রক্ষার জন্য এতকিছু ত্যাগ না করতো। স্বাধীনতার 50 বছর পার হয়ে গেছে। 50 বছর পরে এসে আমরা হয়তো সেই সব বীরদের খুব একটা মনে করতে পারি না যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা এই দেশকে পেয়েছিলাম। যারা নিজেদের জীবন দিয়ে আমাদের জন্য সোনার বাংলাদেশ রেখে গেল তাদের জন্য আমরা কতটা করতে পারছি? আমরা কি পারছি এই সোনার বাংলাদেশের গৌরব ধরে রাখতে? একটি কথা ভীষণ মনে হয়, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন।
তবে এই কঠিন কাজটাকে যদি আমরা সহজ করতে না পারি তবে ৩০ লাখ শরীরের জীবন বৃথা যেতে পারে। আমরা কি তেমনটা হতে দেব? কখনোই না। আমার সোনার বাংলাদেশ যেন পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে থাকে তার জন্য যা করতে হয় করব। সেই সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ আমাদের বারবার অনুপ্রেরণা যোগাবে। আমাদের আজকের পোস্টে আমরা সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ কে নিয়ে ছোট্ট পরিসরে আলোচনা করলাম। পরের পোস্টগুলোতে সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ কে নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে এবং তাদের জীবনী তুলে ধরা হবে। আপনারা যারা সাতজন বীরশ্রেষ্ঠের আরো অনেক অজানা তথ্য জানতে চান তারা চোখ রাখবেন আমাদের পরের পোস্টগুলোতে। পরবর্তী প্রজন্মকে এই সাতজন বীরশ্রেষ্ঠের জীবনী জানানো আমাদের দায়িত্ব। দেশের প্রতি একটা মানুষের কতটা ভালোবাসা থাকতে পারে তা সকলের জানা দরকার।